পাখির প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়েই হয়ত মানুষ উড়তে চেয়েছিল ডানা মেলে। ইতিহাস যখন থেকে টিকে আছে, তার আগেও হয়তো কত মানুষ চেষ্টা করে গেছেন উড়তে। জানার উপায় নেই কেউ সফলও হয়েছিলেন কি না কিংবা জানা যাবে না কোনো ব্যর্থতার গল্পও।
যান্ত্রিক উড়োজাহাজ আবিষ্কারের ১ হাজার বছর আগেই বাতাসের চেয়ে ভারী এক যন্ত্র বানিয়ে আকাশে ওড়েছিলেন নবম শতাব্দীর এক মুসলিম দার্শনিক ও ইঞ্জিনিয়ার।
যুক্তরাষ্ট্র সর্বপ্রথম যান্ত্রিক উড়োজাহাজ আবিষ্কার করলেও তারও বহু আগে নবম শতাব্দীর ইঞ্জিনিয়ার আব্বাস ইবনে ফিরনাস প্রথম মানুষ যিনি এক জোড়া পাখা নিয়ে আকাশে উড়েছিলেন। তার পাখাগুলো তৈরি করা হয়েছিল রেশম, কাঠ ও পাখির পালক দিয়ে।তাকে বলা হয় বিমান এবং বিমানের পিতা। ইবনে ফিরনাস প্রথম মানব বহনকারী গ্লাইডার তৈরি করেছিলেন । আজকে তার জীবন সম্পর্কে কিছু আলোচনা করব।
আব্বাস ইবনে ফিরনাসের পুরো নাম আব্বাস আবু আলকাসিম ইবনে ফিরনাস ইবনে ইরদাস আল তাকুরিনি।
আরমেন ফিরমানকে আব্বাস ইবন ফিরসাসের নামের ল্যাটিনরূপ বলে ধারণা করা হয়। ফিরনাস তার কাজের দ্বারা অণুপ্রাণিত হয়েছিলেন বলে কেউ কেউ মত প্রকাশ করেন।
জন্ম
তার জম্ম ৮১০ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন মুসলিম জ্ঞানচর্চার অন্যতম কেন্দ্র স্পেনের রোনদায়। রোনদা এখন স্পেনের একটি পর্যটন শহর।
শিক্ষার্জন
তিনি যদিও রোনদায় জন্মগ্রহণ করেন, কিন্তু জ্ঞানের প্রতি তার আসক্তি থেকে তিনি রোনদা থেকে কর্ডোবায় গমন করেন। তবে তার আগে তিনি কিছু সময় ইরাকে ব্যয় করেন। তখন বাগদাদের দারুল হিকমাহ ছিল মুসলিম জ্ঞানপিপাসুদের তীর্থস্থান।সেখানে তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের বহু শাখায় তিনি পা-িত্য অর্জন করেন। প্রকৌশল, উড্ডয়ন, চিকিৎসা, রসায়ন, পদার্থ, আরবি সাহিত্য ইত্যাদিতে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন। তারপর ফিরে এসে কর্ডোবায় বসবাস শুরু করেন।
উল্লেখযোগ্য কর্মসমূহ
ইবনে ফিরনাস আল-মাকাতা নামক জলঘড়ির নকশা করেন। এছাড়াও তিনি স্বচ্ছ কাচ নির্মাণের জন্য যন্ত্রের নকশাও প্রণয়ন করেন। তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের জন্য প্ল্যানিস্ফিয়ার নামক যন্ত্র ও পাঠের উপযোগী লেন্স প্রস্তুত করেন। গ্রহ নক্ষত্রের ঘূর্ণন প্রদর্শনের জন্য কার্যকর মডেলও তিনি প্রস্তুত করেন। তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হল পাথরের স্ফটিককে কাটার প্রক্রিয়া। তার এই আবিষ্কারের ফলে স্পেন কোয়ার্টজ কাটার জন্য মিশরের উপর নির্ভরশীলতা থেকে রেহাই পায়। ইতিপূর্বে স্পেন এই ব্যাপারে মিশরের উপর নিভরশীল ছিল।
নিজের বাড়ির একটি কক্ষে নক্ষত্র, মেঘ,বজ্র, আলোকপাত এসব দেখার ব্যবস্থা করেন যা তার ভূগর্ভস্থ গবেষণাগারে যান্ত্রিক পদ্ধতির প্রয়োগের মাধ্যমে করা হয়েছিল। আর বাতাসের চেয়ে ভারী কোনো যন্ত্র নিয়ে আকাশে ওড়া প্রথম মানুষ ইবনে ফিরনাস এবং মানুষের আকাশে ওড়ার পথপ্রদর্শকও এই মুসলিম দার্শনিক।
আকাশে উড্ডয়ন
আকাশে উড়ার প্রচেষ্টার জন্য তিনি অধিক পরিমাণে পরিচিত। বলা হয় তিনি একজোড়া পাখার মাধ্যমে আকাশে উড়েছিলেন। আব্বাস ইবনে ফিরনাস প্রথম মানুষ যিনি এক জোড়া পাখা নিয়ে আকাশে উড়েছিলেন। তার পাখাগুলো তৈরি করা হয়েছিল রেশম, কাঠ ও পাখির পালক দিয়ে। ‘লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি’র (flying machine) নকশাগুলো তৈরি করার ৬০০ বছর আগে এবং রাইট ব্রাদার্সের বিখ্যাত বিমান চালানোর ১০০০ বছরেরও আগে, ইবনে ফিরনাস কাজটি করেছিলেন।
ঐতিহাসিকদের মতে, ইবনে ফিরনাসের বয়স যখন ৬৫ থেকে ৭০ সে সময় তিনি ইয়েমেনের জাবাল আল আরুস পর্বতের চূড়া থেকে উড়াল দেন। ১০ মিনিটের মতো তিনি আকাশে ভেসে থেকে ছিলেন। তবে সংক্ষিপ্ত ওই ফ্লাইটে তাকে আহত ও হতাশ দুটোই হতে হয়েছিলেন। কারণ ইবনে ফিরনাস ওড়ার কারিগরি বিষয়গুলো ঠিকভাবে সম্পাদন করলেও ল্যান্ডিংয়ের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেননি। যে কারণে ওড়ার সময় তিনি ভারসাম্য রাখতে পারেননি। বৈপ্লবিক ওই উড্ডয়নের সমাপ্তি হয়েছিল ক্রাশ ল্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে। ওই উড্ডয়নের পরও ১২ বছর বেঁচে ছিলেন ইবনে ফিরনাস। সে সময়টাতে তিনি এই বিষয়ে কাজ করেছেন। পাখির ওড়া ও অবতরণের ওপর বিস্তর গবেষণা করে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, নিরাপদ ল্যান্ডিংয়ের জন্য দরকার পাখা ও লেজের সমন্বয়।
এরপর ইবনে ফিরনাস তার কয়েক দশকের গবেষণার উপসংহারে পৌঁছান। তার গবেষণাই পরবর্তীতে অরনিথপটার বানানোর পথ দেখিয়েছে। অরনিথপটার হচ্ছে সেই আকাশ যান, যেটি পাখির মতো ডানা ঝাপটে আকাশে ভেসে থাকে। বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এভিয়েশন ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য বিমানের ইঞ্জিন তৈরিতেও ইবনের ফিরনাসের গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
অর্নিথোপ্টার তত্ত্ব
ইবনে ফিরনাসই সেই ব্যক্তি যিনি অর্নিথোপ্টার তৈরি করার পিছনে “উড্ডয়নের ক্ষেত্রে পাখি বিমানের জন্য অনুকরণীয় এবং ডানা ঝাপটিয়ে উড়তে সক্ষম”এই তত্ত্ব সফলভাবে প্রমাণ করেছিলেন। তাঁর উড়ন্ত যানের নকশাগুলো বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিমান চলাচল প্রকৌশলের মূলভিত্তিতে পরিণত হয়েছিল।
মানুষের উড়ার স্বপ্ন
চূড়ান্ত পরিমার্জনের আগে কয়েক দশক পর্যন্ত আকাশে উড়ে বেড়ানো মানুষের জন্য শুধু স্বপ্নই ছিল। সেই শতাব্দীগুলোতে ইতিহাস ছিল রূপকথা আর মনগড়া গল্পে ভরপুর;যেখানে ডানা বিশিষ্ট মানুষ আকাশে অত্যাশ্চর্য সব জিনিস করে বেড়াতো! গ্রীক পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, ইকারাস তার বাবার না যাওয়ার উপদেশ সত্ত্বেও সূর্যের এত কাছে উড়ে গিয়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয় যে তার মোমের পালকগুলি গলে গিয়েছিল ফলে তার দুর্ঘটনা কবলিত অবতরণ ঘটে এবং পরবর্তীতে সে সমুদ্রে ডুবে যায়। ব্যবহারিক বা বাস্তবিক পক্ষে আকাশে উড়ার বিষয়টি তখনই সামনে আসে যখন দুজন চীনা দার্শনিক মোজি এবং লু বান
পরীক্ষামূলক ভাবে সর্বপ্রথম কোনো বস্তুর আকাশে উড্ডয়ন পরিচালনা করেছিলেন। তাদেরকে ঘুড়ির আবিষ্কারকও বলা হয়ে থাকে। ফলাফল স্বরূপ, তাদের এই অগ্রণী ভূমিকার বিনিময়ে তারা পার্শ্ববর্তী প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে সামরিক কলাকৌশল নিজ দেশের জ্ঞানভাণ্ডারে জমা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
স্বরণে ইবনে ফিরনাস
আকাশজয়ের পথিকৃত হিসেবে তাকে ‘বিমানের পিতা’ বলা হয়। বিজ্ঞানে তার অসামান্য অবদানের জন্য চাঁদের একটি গহ্বরকে ‘ইবনে ফিরনাস’ নামকরণ করেন বিজ্ঞানীরা। ইবনে ফিরনাস ছিলেন বারবার বংশের লোক। তার নামের মূলধাতু আফার্নাস হতে উদ্ভূত, যা এখন একটি ব্যাপক প্রচলিত ও সাধারণ নাম হিসেবে মরোক্কো এবং আলজেরিয়া উভয় রাষ্ট্রের মধ্যেই বলতে শুনা যায়। বেশ কয়েকটি বিমানবন্দর, সেতু, পাহাড়, পার্ক,সড়ক এবং বৈজ্ঞানিক সংস্থাকে এই নামে নামকরণ করা হয়েছে, বিশেষ করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে। এমনকি বাগদাদ বিমানবন্দরের কাছেই তার একটি মূর্তি এবং স্পেনের কর্ডোবার গুয়াডাল্কিভির নদীর উপর সেতুটিও তার নামে নামকরণ করা হয়েছে।
অনুপ্রেরণীয় ব্যক্তিত্ব
অনেক ঐতিহাসিক দলিল থেকে জানা যায়, ইবনে ফিরনাস তার গবেষণাকর্মে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন আরমেন ফিরম্যান নামে একজনের দ্বারা। ফিরম্যান বিজ্ঞানী বা দার্শনিক কোনোটাই ছিলেন না, তবে প্রকৃতির একজন বিচক্ষণ পর্যবেক্ষক ছিলেন। ফিরম্যান সর্বপ্রথম রেশম ও পাখির পালকে মোড়ানো তক্তা দিয়ে পাখা তৈরি করেন। ৮৫০-এর দশকের শুরুর দিকে ফিরম্যান করুতোবার (আজকের কর্ডোভা) সবচেয়ে উঁচু মসজিদের মিনারে উঠে এই পাখা নিয়ে ঝাঁপ দেন। যদিও তার সেই চেষ্টা সফল হয়নি, তবে ভাগ্য ভালো যে মাটিতে পড়লেও খুব বেশি আহত হননি ফিরম্যান। পতিত হওয়ার সময় গতি কম ছিল, যে কারণে তিনি বেঁচে যান। ইবনে ফিরনাস সেদিন আরও অনেক মানুষের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ফিরম্যানের সেই অ্যাডভেঞ্চার উপভোগ করেছেন। এরপর তিনি বুঝতে পারেন যে, আকাশে ওড়ার জন্য আরও বেশি গবেষণা দরকার। দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে তিনি পাখি ও বিভিন্ন উড়ন্ত বস্তুর গতিবিধি নিয়ে গবেষণা করেন। এরপর যন্ত্র তৈরি করে ইয়েমেনের জাবাল আল আরুস থেকে আকাশে ওড়েন।
মৃত্যু
তিনি ৮৯০ বা ৮৯৫ সনের মাঝামাঝি সময়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। অনেক ঐতিহাসিকের প্রবল ধারণা মতে, আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে তার মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়েছিল।
তথ্যসূত্র
১) The History of the Mohammedan Dynasties in Spain, Aḥmad ibn Muḥammad Maqqarī, Ibn al-Khaṭīb. Volume 2, Translated By Pascual de Gayangos, Johnson Reprint Company.
২) History of The Arabs - Philip K. Hitti
৩) আলোকিত বাংলাদেশ
২০শে সেপ্টেম্বর ২০২১
৪) বাংলা cnn ৯ই নভেম্বর ২০১৬
No comments:
Post a Comment
We will tell you the answer. Thank You .