একজন মুসলিম ধ্রুপদীর অবদানসূত্রে নবম শতাব্দী স্বতন্ত্র হয়ে ধরা পড়ে। নবম শতাব্দীকে স্মরণে আনলেই এই মুসলিম মনীষী আমাদের স্মরণে আঘাত হানেন।
তিনি ছিলেন একজন বিজ্ঞানী-দার্শনিক-দরবেশসায়েন্টিস্ট -ফিলোসফার-সেইন্ট। আলবাটেগনিয়াস, আলবাটেগনি বা আলবাটেনিয়াস, একাধিক ল্যাটিন নামেও তিনি পরিচিত। আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে জাবির ইবনে সিনান আল রাকি আল হারানি আল সাবি আল বাত্তানি তার নাম। তাকে সংক্ষেপে আল বাত্তানি বলেই চিনি আমরা। নিজের সময়ের তো বটেই, পৃথিবীর ইতিহাসেই জ্যোতির্বিজ্ঞানের উন্নয়নে তাকে অন্যতম একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব বলে গণ্য করা হয়। পাশাপাশি গণিতেও আছে তার বিশেষ অবদান। এসব কাজের পাশাপাশি তিনি বছরের দৈর্ঘ্য নির্ণয় করেছিলেন বেশ সূক্ষ্মভাবে।
জন্ম:
প্রথমেই বলে রাখি আল বাত্তানি সম্পর্কে মধ্যযুগের অন্যান্য মুসলিম মনিষীদের তুলনায় অনেক কম তথ্যই জানা যায়। আল বাত্তানীর জীবন সম্পর্কে যতদূর জানা যায় অধিকাংশের মতে তিনি মেসোপটেমিয়ার উচ্চভূমির অন্তর্গত হাররান নগরীতে(আধুনিক উরফা শহর)৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহন করেন যেটি এখন তুরস্কতে অবস্থিত। তার বাবা ছিলেন বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির বিখ্যাত একজন নির্মাতা। তার উপাধি 'আস সাবী' হওয়ায় অনেকে ধারণা করেন যে তার পূর্বপুরুষ সাবায়িন গোত্রভুক্ত হতে পারে, তবে তার পুরো নাম পড়ে বুঝা যায় তিনি ছিলেন একজন মুসলিম।।
সে সময় হারান শহরের সাংস্কৃতিক এবং শিক্ষা বিষয়ক দিকগুলো বাগদাদের সংস্কৃতি দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত ছিল। তথাপি আল বাত্তানির পূর্বপুরুষরা সাবিয়ান সম্প্রদায়ের (পরবর্তীতে তারা ইসলাম গ্রহণ করে)হওয়ায় তাদের সংস্কৃতির একটি প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল আল বাত্তানির মধ্যে। এক্ষেত্রে তার জ্যোতির্বিজ্ঞানী হওয়া একরকম তার পূর্বপুরুষদের সাবিয়ান বিশ্বাসই নির্ণয় করে দিয়েছিল। কারণ সাবিয়ানরা ঐতিহ্যগতভাবে জোতির্বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক ছিল। বংশের ধারায় আল বাত্তানিও জোতির্বিজ্ঞানের দিকে ধাবিত হন এবং বেশ উন্নতি সাধন করেন। অনেক পশ্চিমা ঐতিহাসিকদের মতে তার পূর্বপুরুষ ছিল আরব রাজাদের মতই উচ্চবংশের। তার পরিবার উত্তর সিরিয়ার অন্তর্গত আর-রাক্কা শহরে বসবাস করতেন।
শিক্ষালাভ:
আল বাত্তানী পিতার নিকটই প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন।তার বাবার নাম ছিল জাবির ইবনে সানান আল-বাত্তানী।তিনিও তার সময়ের একজন বড় বিজ্ঞানী ছিলেন।
শৈশবকাল থেকেই আব্দুল্লাহর (আল বাত্তানি)শিক্ষালাভের প্রতি ছিল তাঁর প্রবল আগ্রহ। তিনি যে শিল্পকর্মেই হাত দিতেন তা নিখুঁতভাবে শুরু করতেন এবং ক্রিয়া, প্রতিক্রিয়া ও ফলাফল গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন। পিতার নিকট প্রাথমিক শিক্ষালাভের পর উচ্চশিক্ষার জন্যে তিনি ইউফ্রেটিস নদীর নিকটবর্তী রাক্কা নামক শহরে গমন করেন।রাক্কা ছিল জ্ঞানার্থীদের জন্যে এক তীর্থস্থান। জ্ঞানান্বেষণে সাগ্রহীরা রাক্কায় যেতেন।এটা ছিল পণ্ডিতদের এক নগরী। জ্ঞানী-গুণী আর প্রাজ্ঞ জনেরা সেখানে বসবাস করতেন। আব্দুল্লাহ নিজের জন্যে সেখানে একটা স্থান করে নিতে সক্ষম হন। মাত্র ২০ বছর বয়সেই তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও পণ্ডিত হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হন। তিনি সেখানে একজন সর্বজনগ্রাহ্য পণ্ডিতরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন
কর্মজীবন:
আল বাত্তানীর বয়স যখন মাত্র ৫ বছর খলিফা মুতাওয়াক্কিলের ইন্তেকাল হয়। পরবর্তীতে দেশের রাজনৈতিক উত্থান পতনের কারণে তরুণ বয়সেই তাঁকে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়তে হয় এবং সিরিয়ার গভর্নর পদে অধিষ্ঠিত হন। রাষ্ট্রীয় কাজের চরম ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি তাঁর জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনার কোন ক্ষতি করেন নি।
জ্যোতির্বিজ্ঞান:
জ্যোতির্বিদ্যায় আল বাত্তানীর সর্বাধিক পরিচিত অর্জন হল সৌরবর্ষ নির্ণয়।আল বাত্তানীই প্রথম নির্ভুল পরিমাপ করে দেখিয়েছিলেন যে, এক সৌর বৎসরে ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৬ মিনিট ২৪ সেকেন্ড হয় যার সাথে আধুনিক পরিমাপের পার্থক্য মাত্র ২ মিনিট ২২ সেকেন্ড কম। জ্যোতির্বিজ্ঞানে টলেমির আগের কিছু বৈজ্ঞানিক ভুলও তিনি সংশোধন করে দেন। সূর্য ও চন্দ্র গ্রহণ সম্পর্কিত টলেমি যে মতবাদ ব্যক্ত করেছিলেন, আল বাত্তানি তা ভুল প্রমাণ করে নতুন প্রামাণিক তথ্য প্রদান করেন। নিকোলাস কোপার্নিকাস কর্তৃক আবিষ্কৃত বিভিন্ন পরিমাপের চাইতে আল বাত্তানীর পরিমাপ অনেক বেশী নিখুঁত ছিল। সূর্য ও পৃথিবীর সর্বোচ্চ অবস্থান সম্পর্কিত টলেমীর একটি তত্ত্ব ভুল প্রমাণ করে আমাদের কাছে তিনি প্রকৃত সত্য উদঘাটন করেন। সঠিকভাবে পরিমাপ করে দেখান, এটা হচ্ছে ১৬ দশমিক ৬৭ ডিগ্রি।
আর্মিলারি স্ফিয়ারের উদ্ভাবক যদিও আল বাত্তানি নন, তথাপি তার তৈরি স্ফিয়ার ছিল পূর্বের সকল যন্ত্রের চেয়ে নিখুঁত এবং উন্নতমানের। এই যন্ত্রের সাফল্য এককথায় অভাবনীয়। তিনি নিজের তৈরি যন্ত্রটি দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব সম্বন্ধীয় যুগান্তকারী তথ্য দেন। “পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে”, ১৫৪৩ সালে কোপার্নিকাসের এই আবিষ্কারের আগপর্যন্ত মানুষ জানতো যে সূর্যই পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে। কোপারনিকাস সূর্যের ইকুইটারিয়েল গতিতে বিশ্বাসী ছিলেন।কিন্তু আল-বাত্তানী তা কখনও বিশ্বাস করতেন না।
আল-বাত্তানী সূর্যের ও চাঁদের গ্রহণের সময়ের সঠিক পরিমাপ নির্ণয় করেন। তিনি ঋতুর সময়-পরিধিও নির্ণয় করেন। সঠিকভাবে সূর্যের কক্ষপথে পরিভ্রমণ পরিস্থিতি তুলে ধরতে সক্ষম হন। তিনি এর সবচেয়ে কম গড়ও নির্ধারণ করেন।
অথচ সেই মধ্যযুগে বসে, ভুল সৌরমডেল নিয়ে কাজ করেও আল বাত্তানি সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন যে পৃথিবী এবং সূর্যের মধ্যে দূরত্ব সর্বদা সমান থাকে না, পরিবর্তিত হয়। এই পর্যবেক্ষণ থেকেই তিনি আরো একটি চমৎকার সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন যে, যখন সূর্যগ্রহণ হয়, তখন চাঁদ সূর্য ও পৃথিবীর মাঝে অবস্থান নেয়। এবং সূর্য যখন পৃথিবী থেকে সর্বোচ্চ দূরত্বে অবস্থান করে, তখন গ্রহণের সময় চাঁদের চারধারে উজ্জ্বল আলোর রেখার সৃষ্টি হয়। অনেক শতাব্দী কোপের্নিকুস কর্তৃক আবিষ্কৃত বিভিন্ন পরিমাপের চাইতে আল বাত্তানীর পরিমাপ অনেক বেশি নিখুত ছিল।
আল বাত্তানি পৃথিবীর বিষুবরেখার মধ্য দিয়ে যাওয়া কাল্পনিক সমতলের সাথে সূর্য ও পৃথিবীর কক্ষপথের মধ্যে যে সমতল, তা অসদৃশ বলে ব্যাখ্যা করেন। বিস্ময়করভাবে তিনি এই দুই কাল্পনিক সমতলের মধ্যকার কোণ পরিমাপ করেন। এই কোণকে বলা হয় ‘সৌর অয়নবৃত্তের বাঁক’। আল বাত্তানি এর পরিমাপ করেন ২৩ ডিগ্রি ৩৫ মিনিট যা বর্তমানের সঠিক পরিমাপ ২৩ ডিগ্রি ২৭ মিনিট ৮.২৬ সেকেন্ডের খুবই কাছাকাছি। তার এ সকল জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় তথ্য রেনেসাঁর যুগে ইউরোপীয় সকল জোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয় ছিল। তারা আল বাত্তানির কাজের উপর ভিত্তি করেই আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করেন।
তিনি তার কিতাব আল-জিজে আকাশে তারকাদের এক বিশাল তালিকা তৈরি করেন এবং ৪৮৯টি তারকার নামকরণ করেন। তার এই কাজকে টলেমির ১০২২টি তারকার নামকরণের চেয়েও মূল্যবান ভাবা হয় এজন্য যে এগুলোর পর্যবেক্ষণ বেশ সূক্ষ্ম ছিল। আসলে তিনি তৎকালীন সময়ের চন্দ্ৰ-সূৰ্য-গ্ৰহ সম্পর্কিত সকল বৈজ্ঞানিক বিশ্বাসে পরিবর্তন আনেন।
গণিত বিদ্যা:
গণিতের বিষয়েও তিনি ছিলেন একজন অগ্রদূত। তিনি গ্ৰীকদের সিম্ফোনি সিস্টেমের বিনাশ সাধন করেন। (গ্রীক স্বরগ্রামের পরিবর্তে লম্বের ব্যবহার করেন) এর পরিবর্তে সূচনা করেন বিশুদ্ধ বানান বিদ্যা বা অর্থে গ্রাফি। তাঁর এ পদ্ধতি আরও উন্নততর বলে প্রমাণিত হয়।
তিনি ত্রিকোণমিতি নিয়ে বিস্তর কাজ করেন এবং সাইন, কোসাইন, ট্যানজেন্ট, কোট্যানজেন্ট ইত্যাদি ধারণা নিয়ে কাজ করেন। গ্লোবোলার ত্রিকোণোমিতির নানা সমস্যার সমাধান দিয়ে গেছেন আল-বাত্তানী।
রচনা সমগ্র:
আব্দুল্লাহ আল-বাত্তানী জ্যোতির্বিদ্যা ও ত্রিকোণোমিতি বিষয়ে অনেক বই লিখে গেছেন। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত বই হচ্ছে : Geej। এটি লাতিন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। রোমের ভ্যাটিকানে এর মূল কপি পাওয়া যায়। রেনেসাঁ-পূর্ব ইউরোপকে তাঁর আবিষ্কার ও ধারণা ব্যাপকভাবে প্রভাবান্বিত করতে পেরেছিল। তাঁর বইগুলো বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল। জ্যোতিবির্দ্যা ও ত্ৰিকোণোমিতি সম্পর্কিত তার আবিষ্কার-উদ্ভাবন ছিল শিক্ষণীয়। বিজ্ঞানের এই দু’টি শাখার উন্নয়নে তাঁর অবদান আমাদের জন্যে প্রেরণার উৎস।
তার বইয়ের গ্রহণযোগ্যতা:
সে সময়কার একজন বিখ্যাত প্রকাশক এবং বই বিক্রেতা ইবনে আন নাদিম আল বাত্তানির কিতাব আল জিজ সম্পর্কে বলেন, “নক্ষত্র এবং তারকারাজি সম্পর্কে এরকম নিখুঁত পর্যবেক্ষণ সমৃদ্ধ বই আগে আরবের কেউ লেখেনি। এই বই ইউরোপীয় এবং অনারবদের মধ্যেও তুমুল জনপ্রিয়।”
মৃত্যু:
৯২৯ খ্রিস্টাব্দের দিকে আল বাত্তানি রাকা থেকে বাগদাদে যাবার জন্য রওনা হন কোনো এক রাজকীয় কর সম্বন্ধীয় প্রজ্ঞাপনের প্রতিবাদে। তবে বাগদাদে তিনি পৌঁছুতে পারেননি। পথিমধ্যে কাসর আল জিস নামক একটি ছোট শহরে৭২ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন।শহরটি ইরাকের সামারার নিকট অবস্থিত। সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়। তার মৃত্যুর পর তার কিতাব আল জিজের জনপ্রিয়তা আকাশ ছুঁয়ে যায়।
No comments:
Post a Comment
We will tell you the answer. Thank You .