Search This Blog

Thursday, December 1, 2022

Hasan Ibnul Haicham | Hasan Ibnul Haicham


আজকের এ বিশ্বকে যে সকল মুসলিম বিজ্ঞানী স্ব-স্ব অবদানের দ্বারা সমৃদ্ধ করে স্বরণীয়-বরণীয় হয়ে আছেন; হাসান ইবনে হাইসাম তাঁদের অন্যতম। তাঁর পুরো নাম, 
আবু আলি হাসান ইবনুল হাসান ইবনুল হায়সাম।

তাকে পশ্চিমারা ‘আল হাজেন’ বলে ডাকে। আবার তার জন্মভূমির নাম বসরা অনুসারে তাকে কখনো ‘আল বসরি’ নামেও ডাকা হয়। তাকে বলা হয় আলোকবিজ্ঞানের জনক। এর বাইরেও তার ছোট-বড় অবদান রয়েছে অ্যানাটমি বা অঙ্গব্যবচ্ছেদবিজ্ঞান, জোতির্বিজ্ঞান, গণিত,চিকিৎসাবিজ্ঞান, প্রকৌশলবিদ্যা, চক্ষুবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, অর্থনীতি, দর্শন এবং সর্বোপরি বৈজ্ঞানিক গবেষণার পদ্ধতিগত উন্নয়নে! প্রশ্ন হতেই পারে, তিনি মানব ছিলেন, নাকি মহামানব? অ্যারিস্টটল পরবর্তী সময়ে এত বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী অল্প কজন বিজ্ঞানীর মধ্যে তিনি একজন।ফার্সি ইতিহাসবিদ আবুল হাসান বায়হাকি তাকে "দ্বিতীয় টলেমি" বলে উল্লেখ করেছেন। 

জন্ম:

আবু আলি আল হাসান ইবনে আল হাসান ইবনে আল হাইথাম বা সংক্ষেপে ইবনে আল হাইথাম, ৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইরাকের বসরা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। 

শিক্ষালাভ:

প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা, সবই তিনি বাগদাদে লাভ করেন। তিনি ছিলেন ধনী পরিবারের সন্তান। সে সময়ে  শিক্ষা অধিক ব্যয়বহুল হওয়ায় কেবল সমাজের ধনীক শ্রেণীই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারতো। অন্যান্য মুসলিম পরিবারগুলোর মতো ইবনে আল হাইছামেরও শিক্ষা জীবন শুরু হয় বসরার একটি মক্তব থেকে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে।

কর্মজীবন:

তিনি তার জন্মস্থান বসরায় উজির এর দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন এবং তার পাশাপাশি গনিত এ দক্ষতার জন্য তার নামডাক ছিলো। তবে কেউ  কেউ বলেন তিনি অর্থমন্ত্রী ছিলেন, আবার কেউ বলেন তিনি ছিলেন নির্মাণ প্রকৌশলী বা সিভিল ইঞ্জিয়ার। তবে তিনি যে পদেই থাকুন না কেন, বসরায় সরকারি কাজ করে সন্তুষ্ট ছিলেন না তিনি

তার জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে কায়রোতে তৎকালীন খলিফা হাকিম বি-আমরিল্লাহর রাজ্যে ভ্রমণ। খলিফা হাকিম বি-আমরিল্লাহ তাকে নীলনদের বন্যা নিয়ন্ত্রণের উপায় বের করার দায়িত্ব দেন। উচ্চাভিলাষী এক পরিকল্পনা তৈরি করে কাজ শুরু করার পর ইবনে আল হাইছাম বুঝতে পারেন যে, তখনকার প্রযুক্তিগত সক্ষমতা দিয়ে সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। অগত্যা সে পরিকল্পনা থেকে তাকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল। তবে এখানে একটি গল্প প্রচলিত রয়েছে। কাজে ব্যর্থ হওয়ার পর হাইছাম খলিফার ক্রোধ থেকে বাঁচতে নাকি পাগলের ভান করেছিলেন এবং গৃহবন্দী হয়ে থেকেছিলেন একেবারে খলিফা হাকিমের মৃত্যু পর্যন্ত! আর এই গৃহবন্দী অবস্থায়ই তিনি লিখেছিলেন তার সেরা বই, ‘বুক অব অপটিকস’, ( তার বিখ্যাত কর্ম, যার আরবী নাম "কিতাব আল মানাযির") যাকে কিনা নিউটনের প্রিন্সিপিয়া ম্যাথম্যাটিকার সাথে পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে অন্যতম প্রভাবশালী বই গণ্য করা হয়। ১০৪০ খ্রিস্টাব্দে কায়রোতেই মৃত্যুবরণ করেন ইবনে আল হাইছাম। তার ব্যক্তিগত জীবন, পরিবার, বিয়ে, সন্তান সম্বন্ধে কিছুই জানা যায় না। 

তার গবেষণা:

ইবনে আল হাইথাম ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম। তবে মুসলিমদের মধ্যে বিদ্যমান জাতিগত দ্বন্দ্ব তাকে পীড়া দিত। তিনি দীর্ঘকাল শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিয়ে গবেষণা করেন। গবেষণার ফলাফল হিসেবে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, এই দ্বন্দ্ব আল্লাহর দেয়া ধর্মগ্রন্থ থেকে উদ্ভুত হয়নি, বরং মানুষই সৃষ্টি করেছে। তবে তিনি যথার্থভাবে এই বিষয়গুলোর সমাধান করতে না পারায় মনঃপীড়ায় ভুগেছিলেন। সবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে ডুব দিয়েছিলেন অ্যারিস্টটলের দর্শনে।

অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে ইবনে আল হাইথাম ছিলেন আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রবক্তা। তার আগে বিজ্ঞানীগণ যে পদ্ধতিতে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ চালাতেন তা যথাযথ ছিল না। ফলে অনেক সময় হাইথামকে বলা হয় প্রথম ‘আধুনিক বিজ্ঞানী’। তিনি যেকোনো বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য কঠোর পরীক্ষামূলক পদ্ধতির প্রচলন করেন। তার পরীক্ষার পন্থা অনেকাংশে আধুনিককালের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মতো। তার পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়ার ধাপ সাতটি-

১পর্যবেক্ষণ

২সমস্যা নির্দিষ্টকরণ

৩সমাধান অনুমান করা

৪পরীক্ষার মাধ্যমে অনুমান যাচাই করা

৫পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করা

৬তথ্যের বিশ্লেষণ, তুলনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ

৭ফলাফল প্রকাশ করা

ইবনে আল হাইথাম কেবল অ্যারিস্টটলে ডুবে ছিলেন না। তিনি ইউক্লিড, আর্কিমিডিস, টলেমির গূবেষণা ও দর্শন বিষয়ে বিস্তর পড়ালেখা করেন। 

তার যুগান্তকারী আবিষ্কার  দৃষ্টিতত্ত্ব:

তবে আলোকবিজ্ঞানের অবদানই তাঁকে আজ স্বরণীয় করে রেখেছে। তিনি আলোর প্রতিফলন, প্রতিসরণ এবং এই প্রতিফলন-প্রতিসরণের ফলে সৃষ্ট নানাবিধ দৃষ্টি বিভ্রম ও মরীচিকা সম্মন্ধে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রদান করেন। আলোর সম্মন্ধে টলেমির থিওরিকে তিনি ভুল প্রমাণ করে দেখান যে, এটি কেবল ক্ষুদ্র কোণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, বৃহৎ কোণের বেলায় এটা খাটে না। ইবনুল হাইসামের মতে, একটি হালকা স্বচ্ছ মাধ্যম থেকে অপেক্ষাকৃত ভারী স্বচ্ছ মাধ্যমে প্রবেশ করার সময় আলোর যে দিক পরিবর্তন হয়, বিভিন্ন মাধ্যমে আলোর বেগের তারতম্যই তার কারণ প্রাচীনকাল হতে দৃষ্টিশক্তি সম্পর্কে দুটো মতবাদ বেশ জনপ্রিয় ছিলো। 

প্রথম তত্ত্ব আলোকবিজ্ঞানে ইউক্লিড ও টলেমির ধারণা বেশ জনপ্রিয় ছিল । ইউক্লিডের আলোক নিঃসরণ তত্ত্ব , যেখানে ইউক্লিড মনে করতো ,” চোখ হতে বস্তুতে আলো পড়ে এবং আমরা সেই বস্তুকে দেখি ” এবারও টলেমি ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ইউক্লিডের তত্ত্বকে প্রাণ দিয়েছেন যেমন ভুল সূত্র দিয়েছিলেন গ্রহ উপগ্রহের গতি সম্পর্কে ।

 দ্বিতীয় তত্ত্ব  অ্যারিস্টটল এবং তাঁর অনুসারীগণ সমর্থন করতেন।আলোক অন্তপ্রেরণ তত্ত্ব ( Intromission theory)

অর্থাৎচোখ থেকে আলো কোনো বস্তুর উপর পড়লে আমরা সে বস্তুটি দেখতে পাই। কিন্তু হাইথাম বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে এটি ভুল প্রমাণিত করেন। যেমন- বহুদূরের তারকারাজি আমরা চোখ মেললেই দেখতে পাই। আমাদের চোখের আলো কতটা শক্তিশালী যে এতো পথ মূহুর্তেই পাড়ি দিয়ে সে তারকার কাছে পৌঁছে যায়? প্রথম ব্যক্তি হিসেবে তিনি ঘোষণা করলেন কোনো বস্তু থেকে আলো আমাদের চোখে এলেই তবে আমরা সে বস্তুটি দেখতে পাই। তিনি আলোকরশ্মির সরল পথে গমনের বিষয়েও পরীক্ষা করেন এবং প্রমাণ করেন।

ড. রাজী উদ্দিন সিদ্দিকীর মতে, বর্তমানে স্নেলের সূত্র নামে পরিচিত আলোর প্রতিফলন ও প্রতিসরণের নিয়ম ইবনুল হাইসাম আবিষ্কার করেন।তবে তার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ কিংবা গাণিতিক ব্যাখ্যা করতে পারেননি হাইথাম।

হাসান ইবন আল হাইসাম পরীক্ষার মাধ্যমে সফলভাবে দেখিয়েছিলেন যে আলো সরল রেখায় চলে, লেন্স, আয়না, প্রতিফলন ও প্রতিসরণ সংক্রান্ত বহু পরীক্ষা নিরীক্ষা সম্পাদন করেছিলেন। তার প্রতিফলন ও প্রতিসরণের বিশ্লেষণ আলোর উল্লম্ব ও আনুভূমিক উপাংশকে আলাদাভাবে বিবেচনা করেছেন।

বর্তমানে ইংরেজি লেন্স শব্দটি ইবনুল হাইসামের আরবিতে ব্যবহৃত ‘আদাসা’ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। ‘আদাসা’ অর্থ মসুরের ডাল, চোখের লেন্স মসুরের ডালের মতো। তাই ল্যাটিন অনুবাদকরা এই আদাসাকে Lenticulum বলে অনুবাদ করেন। এই শব্দটি আজ lens নামে পরিচিত হচ্ছে।

ইবনে হাইসাম পিনহোল ক্যামেরা নামে একটি ক্যামেরা তৈরি করেছিলেন, যাকে পৃথিবীর প্রথম ক্যামেরা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এটি ছিল আলো নিরোধক একটি কাঠের বাক্স। এর কোনো এক পৃষ্ঠে ছোট একটি ছিদ্র হতো, একটি পিন দিয়ে ছিদ্র করলে যতটুকু ছিদ্র হয় ঠিক ততটুকু। তাই এই ক্যামেরার নাম ছিল পিনহোল ক্যামেরা। অন্ধকার ঘরে আলোর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য এবং নিরাপদ উপায়ে সূর্যগ্রহণ দেখার জন্য তিনি এটি ব্যবহার করতেন। অ্যারিস্টটল তাঁর সমস্যায় ক্যামেরা অবস্কিউরার অন্তর্নিহিত নীতির ব্যাখ্যা করেছিলেন, তবে ইবন আল হাইসাম সর্বপ্রথম এর পরিষ্কার বর্ণনা দেন।

ইবনে হাইসামের বহুপ্রতিভা:

আলোক সম্বন্ধীয় গবেষণা:

বুক অব অপটিকস ছাড়াও তিনি আলোকবিজ্ঞানের উপর ‘রিসালা ফিল-দাও’ বা ‘ট্রিটিজ অব লাইট রচনা করেন। এখানে তিনি আলোর প্রতিসরণ, বিচ্ছুরণ, গ্রহণ, রংধনু, অধিবৃত্তিক কাঁচ, বিবর্ধন কাঁচ ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করেন। চোখের জৈবিক গঠন ও ব্যবচ্ছেদ বিষয়েও বিস্তর আলোচনা করেন। তিনি আলো বিষয়ক এতো গবেষণা করেন যে সেগুলো সবিস্তারে বর্ণনা করতে গেলে ভিন্ন একাধিক প্রবন্ধের প্রয়োজন হবে!

গতিবিদ্যা:

ইবনে আল হাইথাম নভোজোতির্বিজ্ঞান নিয়েও বিস্তর গবেষণা করেছেন। তিনি বিভিন্ন ভরের মধ্যকার অদৃশ্য আকর্ষণের কারণে ত্বরণের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন (মহাকর্ষ কী জানতেন তিনি!)। তার ‘মাকালা ফি’ল কারাস্তুন’ নামক গ্রন্থে তিনি বিভিন্ন বস্তুর আকর্ষণ কেন্দ্র নিয়ে আলোচনা করেছেন যা আমরা ‘সেন্টার অব গ্রাভিটি’ নামে জানি। অন্যদিকে তিনি ‘রিসালা ফি’ল মাকেন’ বা ট্রিটিজ অব প্ল্যাসে বস্তুর গতি নিয়েও আলোচনা করেছেন।

তিনিই প্রথম মধ্যাকর্ষন শক্তি সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই দুটি বিষয়েই তার প্রায় সিংহভাগ কাজই হারিয়ে গেছে। অন্যথায় নিউটনের পূর্বেই হয়তো পৃথিবী মহাকর্ষ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেতে পারতো।

মহাকাশ বিজ্ঞান

ইবন আল হাইসাম তার জ্যোতির্বিদ্যার সারনির্যাস গ্রন্থে মহাকাশবিজ্ঞানের আলোচনা করেছেন, তাঁর মতে টলেমির মডেল অবশ্যই ভৌত উপায়ে আলোচনা করতে হবে, কোনো বিমূর্ত অনুকল্প হিসেবে নয়—অন্য ভাষায় আরো অনেক মডেল তৈরি করা সম্ভব হতে পারে যা পর্যবেক্ষণের সাথে ভালো মিলে। ইবন আল হাইসাম মকাকাশের বস্তুসমূহের গতিবিধিকে ভৌত নিয়ম দ্বারা ব্যাখ্যা করতে সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটার অর্থ মাকাকাশীয় বস্তু সমূহও একই ভৌত নিয়মের অধীন এবং এ নিয়মের অধীনে এদের আলোচনা সম্ভব। তিনি চাঁদ সম্বন্ধে লিখেছেন মাক্বালা ফি দাও আল-ক্বমার( চাঁদের আলো সম্পর্কে)।

জ্যোতির্বিদ্যা:

টলেমি সম্পর্কিত সন্দেহ

ইবন আল-হাইসাম তাঁর আল-শুকুক আ'লা বাতলামিউস (টলেমি সম্পর্কে সন্দেহ) তে টলেমির আল-মাজেস্ত এ প্রস্তাবিত সৌরজগত এবং আলোকবিজ্ঞান সংক্রান্ত বিভিন্ন মতের সমালোচনায় অবতীর্ণ হন; এবং এতে বিদ্যমান বিভিন্ন স্ববিরোধী বক্তব্য সমূহের —বিশেষত জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত মতবাদসমূহের— প্রতি নির্দেশ করেন। টলেমির আলমাজেস্ত এ গ্রহসমূহের গতি-প্রকৃতির গাণিতিক প্রকাশ নিয়ে আলোচনা করে। টলেমি নিজেও স্বীকার করেছিলেন যে তাঁর গ্রহের গতি সংক্রান্ত গাণিতিক তত্ত্ব সমূহ সর্বদা একে অপরের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে ব্যর্থ, তবে তিনি এটাও বলেন যে এ বিশেষ তেমন কোনো ত্রুটি নয়। তবে ইবন আল-হাইসাম এ মডেলগুলোর অন্তর্নিহিত বিরোধগুলোর প্রতি কট্টর সমালোচক রূপে আবির্ভূত হন। উদাহরণস্বরূপ, টলেমির মডেলে কাল্পনিক বিন্দু— বিশেষত ইকুয়ান্ট , উৎকেন্দ্রিক —এবং কাল্পনিক রেখা ও বৃত্তাকার পথের ব্যবহারকে আক্রমণ করেন।

গাণিতিক কর্ম:

ইবন আল-হাইসামের গাণিতিক কাজের ভিত্তি ছিলো ইউক্লিড , অ্যাপোলোনিয়াস এর কনিক সেকশনএবং ছাবিত ইবন কুরার কাজের উপর। এবং বীজগনিত এবং জ্যামিতির সম্পর্ক স্থাপনের শুরুর দিকের কাজ করেছিলেন। তাঁর অন্যতম অবদান হচ্ছে গনিতকে ব্যবহার করে ভৌতবিজ্ঞানের আলোচনা। তিনি প্যারাবলয়েডের আয়তন নির্ণয় করতে ক্রমিক স্বাভাবিক সংখ্যার চতুর্থ ঘাতের যোগফল বের করার যে পদ্ধতি বের করেছিলেন তা ইন্টিগ্রাল ক্যাল্কুলাসের অন্যতম একটি ধারণা। তাছাড়া তিনি ‘অ্যানালাইসিস অ্যান্ড সিনথেসিস’এ পূর্ণ সংখ্যার উপর গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ করেছেন। তিনি জোড় পূর্ণ সংখ্যার সূত্র  (2n−1(2n − 1)) আবিষ্কার করেন। অবশ্য সূত্রটি তিনি প্রমাণ করে যেতে পারেননি। গণিতবিদ ইউলার ১৯ শতকে এই সূত্রটি প্রমাণ করেন।

দর্শন:

তাঁর স্থানের উপর আলোচনা গবেষনাপত্রে অ্যারিস্টটলের 'প্রকৃতি শুণ্যতা ঘৃণা করে' এ মতের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি থানের জ্যামিতিক বর্ণনা দিতে চেষ্টা করেছেন। স্থানের বর্ণ্নার প্রয়াসে তিনি বস্তুর তোলের অভ্যন্তরে ত্রিমাত্রিক শুণ্য স্থান কল্পনা করেছেন। পরবর্তীতে তার এ স্থানের জ্যামিতিকীকরণ জনপ্রিয়তা হারায়।

ধর্মতত্ত্ব:

ইবন আল-হাইসাম মুসলিম ছিলেন; তবে ঠিক কোন মতের অনুসারী ছিলেন তা ঠিক ভাবে জানা যায় না। তিনি সুন্নি হলে সম্ভবত আশ'আরী, অথবা মু'তাযিলা ধারার অনুসারী হয়ে থাকতে পারেন। তবে আব্দুল হামিদ সাবরার মতে তিনি শিয়া হতেও পারেন বলে সম্ভাবনা শোনা যায়। ইবন আল হাইসাম ইসলামি ধর্মতত্ত্বের উপর একটি কাজে নবুয়তের আলোচনা করেছিলেন। তিনি গাণিতিকভাবে ক্বিবলার দিক নির্ধারণের জন্য একটি গবেষণাপত্র লিখেছিলেন, সেই ক্বিবলার প্রতিই মুসলিমরা তাদের প্রার্থনা( সালাত ) আদায় করে থাকেন।

ইবনে হাইছামের রচনা:

ইবনে আল হাইথামের মোট কাজের সংখ্যা দুশ’র অধিক, যার মধ্যে ৯৬টি বৈজ্ঞানিক। তবে সেগুলোর মধ্যে বর্তমানে সামান্য বা সম্পূর্ণরূপে টিকে আছে মাত্র ৪৬টি। তথাপি সেই ৪৬টিই তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন গবেষক, পর্যবেক্ষক এবং বিজ্ঞানী হিসেবে। বর্তমানে পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের নিকট যে মুসলিম বিজ্ঞানীর নামটি সবচেয়ে জনপ্রিয় তা হচ্ছে ‘আল হ্যাজেন’ বা আল হাইথাম। তার বুক অব অপটিকস এখনো বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো হয়। এ কাজ গুলোর মধ্যে অধিকাংশ গনিতের উপর, ২৩ টি জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর এবং ১৪ টি আলোকবিজ্ঞানের উপর। সবগুলো কর্মের যথাযথ মূল্যায়ন ও গবেষণা এখনো হয়নি। এদের মধ্যে কিছু প্রধান কাজের তালিকা দেয়া হলো।

১আলোকবিদ্যা গ্রন্থ[কিতাব আল-মানাযির](كتاب المناظر)

২বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণ(مقالة في التحليل والتركيب)

৩জ্ঞানের ভারসাম্য(ميزان الحكمة)

৪আলমাজেস্ত এর সংশোধন(تصويبات على المجسطي)

৫স্থানের উপর আলোচনা[মাক্বালা ফি'ল মাকান](مقالة في المكان)

৬দ্রাঘিমাংশের নির্ভুল নির্ণয়(رسالة في الشفق)

৭অক্ষাংশের নির্ভুল নির্ণয়(لتحديد الدقيق للقطب)

৮হিসাবের মাধ্যমে ক্বিবলার দিক নির্ণয়(كيفية حساب اتجاه القبلة)

৯:টলেমি সম্বন্ধে সন্দেহ[শুকুক আ'লা বাতালামিউস)(شكوك على بطليموس)

১০:কনিক সেকশনের পরিপূর্ণতার উপর(إكمال المخاريط)

১১:তারকারাজির দর্শনের উপর(رؤية الكواكب)

১২:বৃত্তের বর্গীকরণ সম্বন্ধে(مقالة فی تربیع الدائرة)

১৩দহন গোলকের উপর(لمرايا المحرقة بالدوائر)

১৪মহাবিশ্বের কনফিগারেশন সম্বন্ধে(تكوين العالم)

১৫তারার ঔজ্জ্বলের উপর(مقالة في ضوء النجوم)

১৬:জ্যোৎস্নার উপর (مقالة في ضوء القمر)

১৭:ছায়াপথ সম্বন্ধে(مقالة في درب التبانة)

১৮ছায়ার প্রকৃতি সম্বন্ধে(كيفيات الإظلال)

১৯:আলমাজেস্তের উপর সন্দেহের সমাধান((تحليل شكوك حول الجست))

২০ক্বিবলার দিক সম্বন্ধে(تجاه القبلة)

২১:প্রাণীর মানসের উপর সুরের প্রভাব সম্বন্ধে ২২:গবেষণাপত্র(أثير اللحون الموسيقية في النفوس الحيوانية)

২৩:স্থানের উপর গবেষণাপত্র[রিসাল ফি'ল মাকান](رسالة في المكان)

২৪:আলোর উপর গবেষণাপত্র(سالة في الضوء )

২৫:রংধনু ও বর্ণবলয় সম্বন্ধে(مقالة في قوس قزح)

২৬সাতটি গ্রহের প্রতিটির গতির মডেল(نماذج حركات الكواكب السبعة)

২৭:ইউক্লিডের উৎপত্তির ব্যাখ্যা(شرح أصول إقليدس)

হারিয়ে যাওয়া:

১:দহন গোলকের উপর গবেষণাপত্র

২:দৃষ্টিশক্তির প্রকৃতি এবং এর দ্বারা দর্শনানুভূতি উপলব্ধির প্রক্রিয়ার উপর আলোচনা

একটি বই যাতে ইউক্লিড এবং টলেমির আলোকবিদ্যার সারাংশ আলোচনা করেছি আমি, যাতে আমি প্রাথমিক আলোচনার ধারণা যুক্ত করেছি যা টলেমির বইতে অনুপস্থিত

হাইসামের স্বরণে:

তার সম্মানে চাঁদের একটি জ্বালামুখের নামকরণ করা হয় ‘আল হ্যাজেন’। ‘অ্যাস্টেরয়েড ৫৯২৩৯ আল হ্যাজেন’ নামক একটি গ্রহাণুর নামকরণও করা হয় তার সম্মানে। ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক আলোকবর্ষ উপলক্ষে জাতিসংঘ ইবনে আল হাইথামের আলোকবিদ্যা বিষয়ক কাজের ১,০০০ তম বার্ষিকী উদযাপন করে। তার অবদান স্মরণার্থে আগা খান বিশ্ববিদ্যালয় (পাকিস্তান) তাদের অপথালমালোজির প্রধান আসনের নামকরণ করেছে । ১৯৮২ থেকে ১০ ইরাকি দশ দিনার নোট এবং ২০০৩ সাল হতে ইরাকি ১০,০০০ দিনারের নোটে তাঁর ছবি প্রিন্ট করা হয়েছে।

এছাড়াও ২০১৪ সালে নিল ডিগ্রেস টাইসন এর উপস্থাপনায় কসমসঃ আ স্পেস-টাইম ওডিসি তে ইবন আল-হাইসামের আলোকবিদ্যায় অবদানসমূহের প্রতি নির্দেশ করে একটি পর্ব তৈরি করা হয়। এতে ইবন আল-হাইসামের কণ্ঠ দিয়েছেন আলফ্রেড মলিনা।

মৃত্যু:

১০৪০ খ্রিস্টাব্দে কায়রোতেই মৃত্যুবরণ করেন ইবনে আল হাইথাম। তার ব্যক্তিগত জীবন, পরিবার, বিয়ে, সন্তান সম্বন্ধে কিছুই জানা যায় না। তবে তিনি ইতিহাসে জীবন্ত হয়ে আছেন তার কাজের দ্বারা।

তথ্যসূত্র :

* নিশ্চয়তা নীতি কোয়ান্টাম বলবিদ্যা, মোহাম্মদ ইয়াছিন

* হাসান ইবনে আল-হাইসাম , উইকিপিডিয়া

*বিজ্ঞানের আলোক ভ্রমণ : আল হাজেন থেকে আইনস্টাইন ,বিজ্ঞান পত্রিকা আব্দুল গাফফার রনি ,

*ইবনে আল-হাইথাম: আলোকবিজ্ঞানের কান্ডারি এক মহাবিজ্ঞানীর গল্প


 


No comments:

Post a Comment

We will tell you the answer. Thank You .

JFPathagar

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Vestibulum rhoncus vehicula tortor, vel cursus elit. Donec nec nisl felis. Pellentesque ultrices sem sit amet eros interdum, id elementum nisi ermentum.Vestibulum rhoncus vehicula tortor, vel cursus elit. Donec nec nisl felis. Pellentesque ultrices sem sit amet eros interdum, id elementum nisi fermentum.




Comments

Contact Form

Name

Email *

Message *