Search This Blog

Sunday, November 27, 2022

Al-Razee | আল রাজি


একজন মুসলিম সক্রেটিস ছিলেন আল রাজি।শল্য চিকিৎসার প্রাণপুরুষ আল রাজির পুরো নাম আবুবকর মুহাম্মদ ইবন জাকারিয়া আল রাজি বা আল রাজি। তিনি ছিলেন সেই মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানী যিনি গ্রিকদের চেয়েও উন্নত পন্থায় অস্ত্রোপচার করতেন।

ইরানের রাজধানী তেহরান থেকে একটু দূরে কাস্পিয়ান সাগরের ধার ঘেঁষে অবস্থিত সুবিশাল আলজার্স পর্বতমালা। এই পর্বতমালার দক্ষিণের ঢালে বিখ্যাত সিল্ক রোডের পাশের একটি শহরের নাম রে(রায়)।তিনি ৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে (২৫১ হিজরী) ইরানের রায় শহরে জন্মগ্রহণ করেন।তার পুরো নাম আবু বকর মুহম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল রাযি। তার নামের আল রাযি অংশটি এসেছে তার জন্মস্থল থেকে। এর অর্থ ‘রে(রায়ের) এর অধিবাসী’। পশ্চিমা বিশ্বে অবশ্য তিনি আল রাজেস নামে বা জযধুবং বা জধংরং নামে পরিচিত

চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতি ঝোঁক:

তিনি ঠিক কখন চিকিৎসাবিদ্যার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেছিলেন, তা সঠিক জানা যায় না। তবে ধারণা করা হয়, তার বয়স যখন ত্রিশ বা চল্লিশের কোঠায় ছিল তখন তিনি মেডিসিনে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। চিকিৎসাবিদ্যার পাঠ নিতে তখন তিনি বাগদাদে চলে যান এবং সেখানে চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়াশোনা করেন। তারপর স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। এরপর রায়ের গভর্নর মানসুর ইবনে ইসহাক তাকে রে শহরে ফিরে আসার আমন্ত্রণ জানান এবং রে হাসপাতালের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। আল রাযি মানসুর ইবনে ইসহাককে দুটি বই উৎসর্গ করেন- ‘দ্য স্পিরিচুয়্যাল ফিজিক’ এবং ‘কিতাব আল- মানসুরী’। নতুন চিকিৎসক হিসেবে বেশ ভালই সুনাম কুড়িয়েছিলেন আল রাযি। ফলে বাগদাদ থেকে আব্বাসীয় খলিফা আল মু’তাদিদ তাকে ডেকে পাঠান এবং নতুন স্থাপিত একটি হাসপাতালের প্রধানের দায়িত্ব প্রদান করেন। আল মু’তাদিদের পুত্রের শাসনামলে আল রাযি আব্বাসীয় খেলাফতের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল নির্মাণের দায়িত্ব পান। হাসপাতাল কোথায় নির্মাণ করা হবে, সেই স্থান নির্বাচন করতে তিনি এক অভিনব প্রক্রিয়ার সাহায্য নেন। পুরো শহরজুড়ে নানা জায়গায় তিনি কিছু মাংসের টুকরা রেখে আসেন। যে স্থানের মাংস সবচেয়ে পরে পঁচতে শুরু করেছিল সেই স্থানটি হাসপাতাল নির্মাণের জন্য নির্ধারণ করেন তিনি। শিক্ষক হিসেবেও আল রাযির খ্যাতি ও গ্রহণযোগ্যতা ছিল। তার লেকচারের আকর্ষণে দূর-দূরান্ত থেকে অনেক শিক্ষার্থী এসে তার ক্লাসে ভিড় জমাত। মানুষ হিসেবে আল রাযি মহৎ এবং উদারমনা ছিলেন। তিনি দরিদ্র রোগীদের থেকে টাকা নিতেন না।


কীর্তি:

রাজি ছিলেন একজন দক্ষ পারশিয়ান চিকিৎসক ও দার্শনিক।তিনি চিকিৎসাবিদ্যা, আল কেমি, পদার্থবিদ্যা ও অন্যান্য বিষয়ের ওপর ১৮৪টিরও বেশি বই লিখেছেন।এর মধ্যে চিকিৎসাশাস্ত্রেই তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা ১০০। 

তাঁর চিকিৎসাবিষয়ক গ্রন্থের মধ্যে ‘এল হাওয়াই’ সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য। ওই গ্রন্থ ‘লিবার কন্টিনেন্স’ নামে লাতিন ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। আল-রাজির চিকিৎসাবিষয়ক আরেকটি ছোট গ্রন্থ ‘মানসুরি’ বা ‘লবার আলমানসোরিস’। এটি তিনি মানসুর ইবনে ইসহাক নামের জনৈক শাসককে উৎসর্গ করেছিলেন। ওই গ্রন্থে ভ্রমণকারীর জন্য চিকিৎসা উপদেশ, বিষাক্ত প্রাণীর দংশনের প্রতিকারসহ অন্যান্য বিষয় আলোচিত হয়েছে। 

সাইকোলোজির জনক, সাইকোথেরাপির জনক, শিশুরোগ চিকিৎসার জনক এমন অসংখ্য উপাধিও আছে এই জ্ঞান সাধকের। এখনো তাকে 'চিকিৎসকদের চিকিৎসক' হিসেবে গন্য করা হয়। 

'চক্ষু রোগ চিকিৎসার (অফথালমোলোজি) পথ প্রদর্শকও বলা হয়ে থাকে জাকারিয়া আল রাজিকে। আল রাযি প্রথম জীবনে সঙ্গীত ও শিল্পকলায় আগ্রহী ছিলেন। তারপর রসায়ন, জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন, গণিত প্রভৃতি বিষয়ের জ্ঞানার্জন করেন। আল-রাজি রসায়ন শাস্ত্রে অনেক নতুন বিষয় প্রবর্তন করেন। এর মধ্যে বিভিন্ন প্রতীক চিহ্ন অন্যতম। মুসলিম এই মনীষীর জ্ঞানচর্চা বিস্তৃত ছিল নানা বিষয়ে এবং প্রত্যেকটি বিষয়েই তিনি সমান পারদর্শিতা দেখিয়েছেন।পদার্থ ও আলোকবিজ্ঞান সম্পর্কেও তিনি বই লিখেন, যার অনেকগুলেইি বিলুপ্ত। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার অবদান সম্পর্কে চলুন জানা যাক।

চিকিৎসাবিজ্ঞান:

চিকিৎসক হিসেবে আল রাযি অতুলনীয় নিষ্ঠার সাথে কাজ করেন এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রভূত উন্নতি সাধন করেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে তার অবদান বিবেচনা করলে তাকে তুলনা করা যায় শুধু তার এক শতাব্দী পর জন্ম নেয়া চিকিৎসাবিদ ইবনে সিনার সাথে। অনেক বিশেষজ্ঞ আল রাযিকে মধ্যযুগের সেরা চিকিৎসক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাকে সেসময়ের সবচেয়ে সৃজনশীল লেখক বলেও মানা হয়। তিনি পেডিয়াট্রিকস, অপথ্যালমোলজি, নিউরোসার্জারি, সংক্রামক রোগ সহ চিকিৎসাবিদ্যার অনেক শাখার গোড়াপত্তন করেন। তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানের উপর অনেকগুলো ভলিউমের ১০টিরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেন। অনুবাদের বদৌলতে তার চিকিৎসাবিদ্যা সংক্রান্ত গ্রন্থাবলী এবং ধ্যানধারণা মধ্যযুগের ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং পাশ্চাত্যের চিকিৎসাবিদ্যাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।

তার রচিত বেশ কিছু বই পাশ্চাত্যের চিকিৎসাশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠ্যবই হিসেবে পড়ানো হতো। আল রাযির রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে- ‘আল কিতাব আল হাওয়ি’, ‘দ্য ভার্চুয়াস লাইফ’, ‘আল জুদারি ওয়াল হাসবাহ’, ‘আল মানসুরি’ প্রভৃতি। ২৩টি ভলিউমে রচিত ‘আল কিতাব আল হাওয়ি’ গাইনোকলজি, অবেস্ট্রিকস এবং অপথ্যালমিক সার্জারির ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে। নয়টি ভলিউমে রচিত ‘দ্য ভার্চুয়াস লাইফ’ বইটিতে গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল এবং প্লেটোর কাজ সম্পর্কে আলোচনা-সমালোচনা ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে সৃষ্টিশীল ধারণা দেন। এই বইটিতে আল রাযি তার বিভিন্ন বই পড়ে অর্জিত জ্ঞান, নানারকম রোগ এবং তার চিকিৎসা নিয়ে তার পর্যবেক্ষণ, তার রাখা সমস্ত নোটকে একত্রিত করেছেন। শুধুমাত্র এই বইটির জন্য অনেক পণ্ডিত তাকে মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক বিবেচনা করেন। বইটি ইউরোপে ‘The large comprehensive’ বা ‘Continens Liber’ নামে পরিচিত।

তিনিই প্রথম চিকিৎসক, যিনি হাম এবং গুটি বসন্তকে আলাদা রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেন। এর আগে দুটো রোগকে একই ভাবা হতো। হাম এবং গুটিবসন্ত সম্পর্কিত তার পর্যবেক্ষণ স্থান পেয়েছে তার ‘আল জুদারী ওয়াল হাসবাহ’ গ্রন্থে। আল রাযি রচিত আরেকটি যুগান্তকারী গ্রন্থ হচ্ছে ‘Doubts about Galen’। এই বইটিতে তিনি গ্রীক চিকিৎসক গ্যালেনের অনেক ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেন। তার পর্যবেক্ষণের সাথে গ্যালেনের অনেক দাবীই সাংঘর্ষিক ছিল। এমনকি গ্যালেন জ্বরের যে লক্ষণের কথা উল্লেখ করে গেছেন, আল রাযি জ্বরের রোগীর সাথে তারও কোনো মিল পাননি। আল রাযির ‘The Diseases of Children’ বইটি পেডিয়াট্রিকসকে চিকিৎসাবিদ্যার স্বতন্ত্র একটি শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। আল রাযী চিকিৎসাক্ষেত্রে নৈতিকতা নিয়েও কাজ করেছেন। তিনি সেসময়ে শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভুয়া ডাক্তারদের দমন করেন। একইসাথে তিনি এটাও বলে গেছেন যে, উচ্চশিক্ষিত এবং অভিজ্ঞ কোনো চিকিৎসকের কাছেও সব রোগের নিরাময় নাও থাকতে পারে, এটা এক কথায় অসম্ভব। তবে তিনি চিকিৎসকদের আধুনিক জ্ঞান এবং নতুন নতুন তথ্যে সমৃদ্ধ হতে বলেছেন। তিনি গরীব, অসহায় লোকজন, মুসাফিরদের জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা সংক্রান্ত পুস্তিকা রচনা করেন, যাতে করে তারা ডাক্তার কাছে না থাকলেও নিজেদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারে।

মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অবশ্য তার ধারণা সমসাময়িক চিকিৎসকদের মতোই ছিল। তিনি মনে করতেন, শয়তানের প্রভাবেই মানসিক রোগ হয়ে থাকে। তবে তিনি এও বলেছেন, মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি নির্দোষ, তাই রোগী চিকিৎসা ও যত্নের দাবী রাখে।  চিকিৎসাবিজ্ঞানে বহুবিধ মূল্যবান অবদানের জন্য তাকে ‘চিকিৎসকদের চিকিৎসক’ বলা হয়।

রসায়ন:

আল রাযি ছিলেন বহুবিধ প্রতিভার অধিকারী। চিকিৎসাশাস্ত্রের পাশাপাশি রসায়নশাস্ত্রেও তিনি তার পাণ্ডিত্যের ছাপ রেখেছেন। তিনি একইসাথে জৈব ও অজৈব রসায়ন নিয়ে কাজ করেছেন।। 

তিনি সালফিউরিক অ্যাসিড আবিষ্কার করেন। তিনি ইথানল উৎপাদন, বিশোধন ও চিকিৎসায় এর ব্যবহার প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন। তিনি একজন বিখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ছিলেন। তিনি বহু দেশ ভ্রমণ করেন।

মধ্যযুগের অন্যান্য রসায়নবিদের মতোই তিনিও বিশ্বাস করতেন,পরশ পাথরের সাহায্যে সাধারণ ধাতুকে স্বর্ণে রুপান্তর করা সম্ভব। পরশ পাথরের সন্ধানে তিনি বেশ ভালোই মাথা ঘামিয়েছেন এবং দুটো বইও লিখেছেন- ‘The Secrets’ এবং ‘The secrets of Secrets’। তার সমসাময়িক পণ্ডিতদের ধারণা, তিনি নাকি কপারকে স্বর্ণে রুপান্তরিত করতে পেরেছিলেন! উল্লিখিত বই দুটি ছাড়াও আল রাযি রসায়নে আরও কিছু বই লিখেছেন।

জীবনের শেষ মুহূর্ত:আল রাযির জীবনের শেষ দিনগুলো খুব দুর্দশায় কেটেছে। তার চোখে প্রথমে ছানি পড়ে, তারপর তিনি গ্লুকোমায় আক্রান্ত হন। তার চোখের অসুস্থতাজনিত বিপর্যয়ের শেষ হয় অন্ধত্বে। তার অন্ধত্বের কারণটি ধোঁয়াশাতেই রয়ে গেছে। কেউ বলেন, তার চোখে কোনো রাসায়নিক পদার্থ পড়েছিল বলে তিনি অন্ধ হয়ে যান। আবার কেউ বলেন, তিনি অন্ধ হননি, তাকে অন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এর জন্য দায়ী করা হয় তার এককালের পৃষ্ঠপোষক মানসুর ইবনে ইসহাককে। আল রাযি নাকি রাসায়নিক কোনো এক পরীক্ষা প্রমাণ করতে পারেননি- এই অপরাধে ইবনে ইসহাক তাকে এই নির্মম শাস্তি দেন। 

রসায়নশাস্ত্রের অন্যতম প্রবর্তকঃ

রসায়নশাস্ত্রে অনেক নুতন বিষয়ের প্রবর্তন করায় বর্তমান দর্শনশাস্ত্রের অন্যতম প্রবর্তক হিসেবে বিবেচনা করা হয় আল-রাজীকে। এর মধ্যে বিভিন্ন প্রতীক এবং চিহ্ন অন্যতম। তিনি একই সাথে জৈব ও অজৈব রসায়ন নিয়ে কাজ করেছেন।  তিনি অ্যালকোহল অন্যান্য অনেক যৌগ এবং রাসায়নিক পদার্থ আবিষ্কার করেছেন। যার মধ্যে অন্যতম হলো কেরোসিন। ৯ শতকে  তিনি তার বই কিতাব আল আসরারে কেরোসিন উৎপাদনের দুটি পদ্ধতির কথা লিখেন

বিশ্বে সর্বপ্রথম টিকার আবিষ্কারক:

বিশ্বে সর্বপ্রথম টিকার আবিষ্কারক হলেন মুসলিম বিজ্ঞানী ইরানি চিকিৎসক মুহাম্মাদ ইবনে জাকারিয়া আল-রাজি। সময়কাল (৮৫৪-৯৩২ ইসায়ি) গুটি বসন্তের টিকা আবিষ্কার করেছিলেন এবং এর ফলাফলও ছিল চমকপ্রদ। পশ্চিমা ঐতিহাসিক বিবরণীতে পাওয়া তথ্যমতে, টিকা দেওয়ার প্রথা শুরু হয়েছিল মহামারি গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে। যখন এ রোগটি ইংল্যান্ডকে বিধ্বস্ত করেছিল। অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ এবং আমেরিকায়ও এ গুটিবসন্ত থাবা বসিয়েছিল। অন্যদিকে তখন উত্তর আফ্রিকা, অটোমান সাম্রাজ্য এবং মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে টিকা দেওয়া রুটিন অনুশীলন ছিল। ইসলামি বিশ্বে যেখানে টিকার প্রচলন ছিল; সেখানে ইংল্যান্ডে প্রচলন ছিল ভয়াবহ কুসংস্কারের। গির্জার পাদ্রিরা টিকাদানের বিরুদ্ধে আইন জারি করল। তারা রোগের চিকিৎসায় ভয়াবহ অবৈজ্ঞানিক আচার-আচরণ অনুশীলন করত, যা একটি রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে এমন ধারণার বিরুদ্ধে তীব্র আপত্তির জন্ম দেয়।

১৭১৬ থেকে ১৭১৮ সালের মধ্যে ইস্তানবুলে থাকা ইংরেজ রাষ্ট্রদূতের স্ত্রী লেডি মন্টাগু ইংল্যান্ডে ভ্যাক্সিন ব্যবহারের প্রচলন করেছিলেন। তুরস্কে অবস্থানরত ইংল্যান্ড এর দূতাবাসের সার্জন চার্লস মাইটল্যান্ডের দ্বারা তার ছেলেকে সফলভাবে টিকা দেওয়ার পর এ পদ্ধতির কার্যকারিতা দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। লেডি মন্টাগু তার চিঠিতে এবং ইংল্যান্ডে ফিরে আসার সময় পদ্ধতিটি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে লিখেছিল, গুটিবসন্ত থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় হিসেবে টিকা নিয়েছিল। যদিও সে গির্জার পাদ্রি এবং চিকিৎসকের কাছ থেকে ব্যাপক বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিল, তবে সে নিজের অবস্থান অনড় রেখে টিকা প্রদান পদ্ধতিটি প্রচারণা চালায় এবং ইংল্যান্ডবাসীকে টিকা গ্রহণ করতে সফল হয়। ইস্তানবুলে মন্টাগু পরিবারের চিকিৎসক Dr. Emmanuel Timonius ১৭২৪ সালে কথিত রয়েল সোসাইটিতে ইনোকুলেশনের বৈজ্ঞানিক বিবরণ জমা দেওয়ার সময় মুসলমানদের এ টিকা দান কর্মসূচিকে জোরালো সমর্থন করে। এছাড়া তৎকালীন এ টিকাদান কর্মসূচিকে সমর্থন করেছিল ত্রিপোলির রাষ্ট্রদূত কাসেম আগা। কাসেম আগার রিপোর্টে ত্রিপোলি, তিউনিস, আলজিয়ার্স এবং মুসলিম বিশ্বের বেশিরভাগ অংশে এর প্রথম ব্যবহার এবং নিরাপত্তার বিবরণ দিয়েছেন।

কথিত রয়্যাল সোস্যাইটিতে Dr. Timonius লিখেছিল-সার্কাসিয়ান, জর্জিয়ান এবং অন্যান্য এশিয়াটিকরা কনস্টান্টিনোপলে তুর্কি এবং অন্যদের মধ্যে প্রায় ৪০ বছর ধরে এক ধরনের টিকা দিয়ে গুটিবসন্ত নিরাময় করার এ প্রথা চালু করেছে। অপারেশনের পর থেকে, সব বয়সের পুরুষ-মহিলা এবং ভিন্ন স্বভাবের ব্যক্তিদের ওপর এ টিকার প্রয়োগ করা হয়েছে যার ফলে পার্শপ্রতিক্রিয়ায় কেউ মারা যায়নি। যাদের ওপর এই টিকা প্রয়োগ করা হয়েছে তারা খুব সামান্য উপসর্গের মুখে পড়েছে, কিছু দুর্লভ ক্ষেত্রে তাদের কেউ কেউ অসুস্থ হয়েছে। সবচেয়ে মূল্যবান প্রাপ্তি হলো গুটি বসন্ত কখনোই মুখে দেখা দেয় না এবং মুখে দাগ বা গর্ত করে না। অথচ এত প্রমাণ থাকার পর ও পশ্চিমা বিশ্ব নির্লজ্জের মতো এ মুসলিম বিজ্ঞানী আল-রাজির টিকা আবিষ্কারের কৃতিত্ব ১৭৯৬ সালে ‘অ্যাডওয়ার্ড জেনার’ এবং ‘লুইস পাস্তুরের নামে চালিয়ে দিয়েছিল।

যুগের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকঃ

অনেক পণ্ডিত তাকে মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এছাড়াও চিকিৎসাশাস্ত্রের নৈতিকতা নিয়েও কাজ করেছেন তিনি। সেসময় শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভুয়া ডাক্তারের দমন করেন।  তিনি গরীব অসহায় ও মুসাফির লোকদের জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা সংক্রান্ত বই লেখেন, যাতে করে তারা ডাক্তারের কাছে যেতে না পারলেও নিজেদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারে।  খলিফা আল মুতাদিদের শাসন আমলে আল-রাজী আব্বাসীয় খেলাফতের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল নির্মাণের দায়িত্ব পান।  হাসপাতাল নির্মাণের স্থান নির্বাচন করতে তিনি এক অভিনব প্রক্রিয়া সাহায্য নেন।  পুরো শহর জুড়ে নানা জায়গায় তিনি মাংসের কিছু টুকরা রেখে আসেন,  যে স্থানের মাংস সবচেয়ে পরে পচতে শুরু করেছিল সেই স্থানটি হাসপাতাল নির্মাণের জন্য নির্ধারণ করেন তিনি। তাঁকে ডক্টর অব ডক্টর প্যাডিয়াট্রিকের পিতা এবং অস্থি বিজ্ঞানের অগ্রদূত হিসেবে অভিহিত করা হয়। এছাড়াও সাইকোলজির জনক, সাইকোথেরাপির জনক, শিশু রোগ চিকিৎসার জনক, এমন অসংখ্য উপাধিও আছে এই জ্ঞান সাধকের।

অবাক করা এক ঘটনা:

দিনরাত পশু-পাখির চোখ নিয়ে পড়ে থাকতেন তিনি। মাইক্রোস্কোপের নিচে দেখতেন চোখের সুক্ষাতিসুক্ষ ব্যাপার স্যাপার। তখন তিনি আবিষ্কার করলেন চোখের যে রেটিনা আছে সেই রেটিনার স্তর বা লেয়ার আছে মোট ১০টি। 

ঘটনা এ পর্যন্ত হলে কোনো সমস্যা ছিলো না। বিজ্ঞানের ৮/১০ টা আবিষ্কারের মতো এটিও হতো একটি স্মরণীয় ঘটনা। কিন্তু এই ঘটনাই পরে আল রাজিকে অন্ধ করে দেয়। কিংবা তার অন্ধত্বের পেছনে পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলে। 

৮০০ খ্রিস্টাব্দ। জাকারিয়া আল রাজির নিজের চোখেই কঠিন একটা রোগ হলো। রোগের নাম গ্লুকোমা। চোখ সম্পর্কে ঐ সময়ে তারচেয়ে বেশি আর কেউ জানে-টানে না। তবে চোখ সম্পর্কে জানা এবং চোখের চিকিৎসা দুইটা ভিন্ন জিনিস। ইরানের এক প্রখ্যাত চক্ষু চিকিৎসক তাঁকে বললেন, 'আসেন আমার কাছে। আপনার চোখের চিকিৎসা করে দেই।' 

আল রাজি গেলেন সেই চিকিৎসকের চেম্বারে। টেবিলের ওপাশে চিকিৎসক, আর এপাশে আল রাজি। আল রাজি চক্ষু চিকিৎসককে জিজ্ঞেস করলেন, 'আচ্ছা! ঠিক আছে আপনি আমার চোখের চিকিৎসা করবেন খুব ভালো কথা। কিন্তু তার আগে বলেন তো দেখি রেটিনার স্তর কয়টা?

চিকিৎসক হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন। কারণ আল রাজি ছাড়া ১০টা লেয়ারের কথা আর কেউ-ই তখন জানে না। চিকিৎসক উত্তর দিতে পারলেন না। আল রাজি বললেন, 'যে লোক রেটিনা সম্পর্কে জানে না তার কাছে আমি চিকিৎসা করাবো না।আসসালামু আলাইকুম, এভাবে তৎকালীন বিভিন্ন চিকিৎসক আল রাজির চিকিৎসা করতে চাইলেন। সবাইকে তিনি জিজ্ঞেস করতেন, 'রেটিনার লেয়ার কয়টা?' কেউই উত্তর দিতে পারতেন না। 

জাকারিয়া আল রাজিও আর তাঁর চোখের চিকিৎসা করালেন না। কিছুদিন পরে যা হওয়ার তা-ই হলো। চিকিৎসা না করানোর কারণে জাকারিয়া আল রাজি অন্ধ হয়ে গেলেন।

মৃত্যু:

মহান এই মনীষী ৯২৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মস্থান রে শহরে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর তার খ্যাতি দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। সেসময়ে জন্ম নেওয়া আরেক খ্যাতিমান মুসলিম মনীষী আল বিরুনী প্রথম আল রাযির জীবনী লিখেন। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গৌরবময় অবদানের জন্য তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

তথ্য সূত্র:

আলোকিত বাংলাদেশ ৯/১২/২০২১

Shetty, Priya (2011, July 2).

Arabic Roots of Modern Medicine.

The Lancet,378(9785),

https://www.thelancet.com/„/PIIS0

140-6736(11„/fulltext

• Ibid.

• ÒInoculation from East to WestÓ,

1001 Inventions,

1001inventions.com/feature/inocula

tion/

• Boylston, Arthur (2012, July),

The origins of inoculation. Journal

নয়া দিগন্ত:১৪/৯/২০১৯

কালের কণ্ঠ:১৩/৮/২০২১


No comments:

Post a Comment

We will tell you the answer. Thank You .

JFPathagar

Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Vestibulum rhoncus vehicula tortor, vel cursus elit. Donec nec nisl felis. Pellentesque ultrices sem sit amet eros interdum, id elementum nisi ermentum.Vestibulum rhoncus vehicula tortor, vel cursus elit. Donec nec nisl felis. Pellentesque ultrices sem sit amet eros interdum, id elementum nisi fermentum.




Comments

Contact Form

Name

Email *

Message *